শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

অন্দরমহল, সাদাত হোসাইন, রিভিউ

 


গঙ্গাবতী নামের নদীর তীরঘেষে গড়ে ওঠা এক প্রাচীন জমিদারবাড়ি গঙ্গামহল যার নাম। চারখানা দ্বিতল অট্টালিকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই মহলে থাকেন জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ ও তার তিন পুত্র। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী জেষ্ঠপুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণ পরবর্তী জমিদার হওয়ার কথা থাকলেও সকলের ধারণা জমিদার হিসেবে তিনি উপযুক্ত নয়। কেননা তিনি অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং খেয়ায়ী একজন মানুষ বরং দ্বিতীয় পুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণের মধ্যে রয়েছে জমিদার হওয়ার মত সকল গুণাবলী। দেবেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহল থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে বারোহাটির জঙ্গলের কোল ঘেষে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব এক মহল, বারোহাটি বাগানবাড়ি যার নাম। সকল প্রকার ভোগ-বিলাসের আয়োজন রয়েছে এই মহলে। 

কাহিনীর সূত্রপাত হয় এই মহল থেকেই। প্রচন্ড রকমের এক উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সূচনা হওয়া এই উপন্যাসকে প্রথম দিকে আমার কাছে একটা থ্রিলার বলেই মনে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই যেকোন জমিদার বাড়িকে ঘীরে থাকে রহস্যময় ইতিহাস। গঙ্গামহলকে ঘীরেও রয়েছে অজস্র রহস্য। শুরুতে সেইসব রহস্যের কিছু কিছু ইঙ্গিত দিয়ে লেখক খুব চমৎকারভাবে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। গভীর রাতে বারো-তেরো বছরের গুটিবসন্তে আক্রান্ত একাকী অচেনা এক বালকে আবিষ্কার করা হয় নদীতে ভাসমান নৌকায়। এদিকে বারোহাটির বাগানবাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ এক কক্ষ থেকে সম্পূর্ণ হাওয়া হয়ে যায় দেবেন্দ্রনারায়ণের পছন্দের এক নর্তকী হেমাঙ্গিনী দেবী। 
সবকিছু মিলিয়ে শুরুতেই পাঠকের হৃদয়ে যে অপূর্ব কৌতুহল সৃষ্টি হয় তা শুধু লিখে প্রকাশ অসম্ভব। লেখকের কাহিনী বর্ণনার দক্ষতার এক্ষেত্রে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। তবে গল্পের আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতেই লেখক সচেতনভাবেই প্রায় সকল রহস্যের জট ছাড়িয়ে দিয়েছেন এবং এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হয়েছে এটা শুধুমাত্র একটা থ্রিলার উপন্যাস নয় বরং লেখকের আধ্যাত্মিক চিন্তার চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এখানে। লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে মানুষ তার জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে প্রতিনিয়ত যে স্বার্থ চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে উঠছে তার পরিনাম কতটা ভয়ঙ্কর সেদিকেই উপন্যাসের ফোকাস চলে গেছে। 
পার্থিব সম্পদের প্রতি অবনীন্দ্রনারায়ণের কখনই আগ্রহ ছিলো না। তার স্ত্রী বীণাবালার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাই তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। কিন্তু বীণাবালার কূট কৌশলের কাছে হার মেনে অবশেষে অন্য এক সম্পদের সন্ধানে গৃহ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েন অবনীন্দ্রনারায়ণ। চলে যাওয়ার পূর্বে জমিদারবাড়ির দেওয়ালে লিখে রেখে যান জীবনের এক শাশ্বত সত্য, “আমাদের কিছুই নেই, অথচ সবটা সময় জুড়ে ভাবি, এই বুঝি নিঃস্ব হলাম!”। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে লেখক যে গানগুলো লিখেছেন সেগুলো তার আধ্যাত্মিক চিন্তার গভীরতার প্রকাশ। 
রতনকান্তি, হরিহরণ প্রভৃতি সাধারণ চরিত্র হয়েও লেখকের সুনিপুণ দক্ষতায় হয়ে উঠেছেন অতি অসাধারণ। দেবেন্দ্রনারায়ণের জেষ্ঠ্য কন্যা সর্বজয়ার প্রতি এক কর্তব্যবোধ থেকে শেষ পর্যন্ত মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয় রতনকান্তি। গভীর রাতে সুগভীর জঙ্গলে অভিযান চালানো হরিহরণ সহজেই পাঠকের হৃদয় জয় করে নেয়। 
উপন্যাস শেষ করার পর পাঠকের হৃদয়ে সত্যিই এক দার্শনিক সত্যের উপলব্দি হয়, যে অর্থ সম্পদের মোহে আমরা ন্যায়-অন্যায় ভুলে স্বার্থসিদ্ধির জন্য হয়ে উঠি নির্মম, সেই সম্পদ আসলে ক্ষণস্থায়ী এবং এই ধন-সম্পদ কখনও প্রকৃত সুখ এনে দিতে পারে না। সংসারের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে সেই সুখের সন্ধান পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। সেই প্রকৃত সুখের সন্ধান পেতে হলে পার্থিব সম্পদের প্রতি মায়া ত্যাগ করতে হবে। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন