শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


“গোরা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত উপন্যাস। শুধু বিখ্যাত না বলে বলা যায় এটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এমন ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ উপন্যাসের সাথে তুলনা করার মত আর কোন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল। উপন্যাসটি প্রবাসী পত্রিকা ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এবং ১৯১০ সালে পুস্তকাকারে প্রাকাশিত হয়। উপন্যাসটির বিষবস্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সংঘটিত ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন, সামাজিক অধিকার, দেশপ্রেম ও নারীমুক্তি। 


উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গৌরমোহন তথা গোরা। সমগ্র উপন্যাসজুড়ে গোরা’র গভীর ব্যক্তিত্ব, শারিরীক ও মানসিক অমিয় তেজ পাঠককে মুগ্ধ করে রাখলেও প্রকৃতপক্ষে গোরা উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বিশেষ করে গোরা’র মা আনন্দময়ী যিনি এক সময় শাস্ত্রিক আচারনিষ্ঠ হিন্দু রমণীই শুধু ছিলেন না, সব ধরনের নিয়মবিধি মেনে চলাই ছিল তার প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞ। এই অসাধারণ মমতাময়ী অথচ গভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং সংস্কারবিহীন নারী চরিত্রটি যত আবিষ্কার করেছি ততই অবাক হয়েছি। অতি বাল্যকাল থেকেই আনন্দময়ী শিব পূজায় অভ্যস্ত ছিলেন। বিয়ের পরও স্বামীগৃহে তার এই প্রথাসিদ্ধ বিধির কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু একদিন তিনি তাঁর সমস্ত ধর্মীয় কঠিন আবরণকে ছিন্ন করে বেরিয়ে আসলেন। আইরিশ বংশোদ্ভূত গোরাকে কোলে নিয়ে তিনি ভুলে গেলেন তার ধর্ম, বংশ আর জাত-পাত। প্রকৃত নারীমুক্তির এক অনন্য নিদর্শন হয়ে রইলেন আনন্দময়ী। গোরার সঙ্গে মহামিলনের শুভক্ষণে তিনি শুধুই হয়ে গেলেন মা।

পরেশবাবু যিনি ব্রহ্ম সমাজের প্রতিনিধি এই উপন্যাসের আরেকটি অনন্য চরিত্র। পরেশবাবুও কুসংস্কার বর্জিত, ন্যায়বান, উদার ও স্থির চরিত্রের একজন মানুষ। যেকোন ব্যপারে তার অবিচল ধৈর্য্য এবং প্রখর প্রজ্ঞা অন্যান্য চরিত্রকে ব্যপকভাবে প্রভাবিত করে। পরেশবাবুর দুই মেয়ে ললিতা ও লীলা এবং পালিতকন্যা সুচরিতাও উপন্যাসের আলোচিত চরিত্র। বিশেষ করে ললিতা চরিত্রটির মধ্যে আমরা বাঙলা উপন্যাসের একদম আদিম নারীমুক্তির প্রতীককে পাই, যে চরিত্র সমাজ বা পরিবারের সব বাধা ডিঙিয়ে একলা রাতের বেলা এক পরপুরুষের সঙ্গে একটা বোটে চড়ে বসতে পারে, কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় সমাজ কী বলে তার থেকে কোনটা উচিত এটাই যার থেকে বেশি অগ্রাধিকার পায়, এমনকি নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য আপন সমাজ এবং ধর্মকেও যে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করতে পারে।

পরেশবাবু চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত সুরচিতা চরিত্রটি গোরা উপন্যাসের আরেকটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। সুচরিতা একজন দ্বিধাযুক্ত চরিত্র এবং নানা কারণে মনে হতে পারে সুরচিতা চরিত্রটি যথেষ্ট বিকশিত হয়ে পারেনি। গোরা’র সাথে তার আলাপচারিতায় ক্রমেই সে গোরা’তে নিমজ্জিত হয় এবং একটা সময় সে গোরাকেই তার গুরুর পদে অভিসিক্ত করে। গোরাকে যেমন সে ভুলতে পারে না, তেমনি সমাজের সংস্কার ভাঙতেও ললিতার মতো সাহসী হতে পারে না। সুচরিতার মধ্যে আমরা চিরন্তন বাঙালি নারীর পরিচয় পাই।

এই উপন্যাসের আলোচনায় প্রথমেই যে চরিত্রের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল সেটি হল বিনয়ক কেননা সমগ্র উপন্যাসটি মূলক বিনয়ককে ঘীরেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিনয়ক একটি দ্বিধান্বিত চরিত্র। সে গোরার বন্ধ এবং ললিতার প্রেমিক। ব্রাহ্ম সমাজের সাথে তার ওঠাবসা গোরা কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারে না। এটা নিয়ে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের সংকটও তৈরি হয় এক সময়ে।

শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত গোরার মধ্যে তীব্র জাতীয়তাবোধ এবং  ব্রাহ্মণ্যবাদের ঐতিহ্য রক্ষার সংকল্প দেখা যায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গোরা জানতে পারে তার জন্ম পরিচয়। সে নিজেই আসলে ব্রাহ্মণ তো নয়ই বরং এক আইরিশ দম্পতীর সন্তান। এই সত্য জানার পর গোরার সকল অহংকার বালির বাধের মত ভেঙ্গে পড়ে। শেষ আশ্রয় হিসাবে সে শরণাপন্ন হয় পরেশবাবুর। নিজেকে সংশোধনের জন্য সে পরেশবাবুকে বলে,

আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন- যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’

আনন্দময়ীকে সে বলে-

মা, তুমিই আমার মা! যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা! তুমিই আমার ভারতবর্ষ!.....’

গোরা একটি বৃহৎ উপন্যাস যার পরিসমাপ্তিতে এমন এক আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে যা একটি ধর্মের প্রাচীর বিহীন মঙ্গলময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়।


 

1 টি মন্তব্য: