রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

গুহা মানব-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয়

 


কাহিনীর বৈচিত্রতা এবং চমৎকার উপস্থাপন দক্ষতার কারণে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয় আমার প্রিয় লেখকদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। বিশেষ করে তার লেখা শিশুতোষ উপন্যাসগুলি (অদ্ভুতুড়ে সিরিজ) আমার খুব প্রিয়। এই কাহিনীগুলো আমার কাছে নির্মল বিনোদন। গুহা মানব উপন্যাসটি পড়ার পর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয়ের প্রতি ভালোলাগা আরো গভীর হয়েছে। যদিও এটি একটি ছোট উপন্যাস এবং অনেকের কাছেই গল্পটা খুব সাধারণ মনে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে উপন্যাসটি একটি লেখকের একটা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় বলেই মনে হয়েছে।


বটকৃষ্ণ রায়, আর্মির অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। বয়স হলেও সুঠাম দেহের অধিকারী, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক পুরুষ। সম্প্রতি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এবং তার পরপরই স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে। পুত্রবধূ পিঙ্কির বয়স অল্প, আঠারো কি ঊনিশ হবে, স্বাধীনচেতা, শরীরের প্রতি প্রচন্ড যত্নবান, বাড়িতে প্রতিনিয়ত ব্যয়াম করে, খাওয়া-দাওয়াও অনেক মেপে। বৌমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না বটকৃষ্ণ রায় বা বটু বাবু। তবে সেটা নিয়ে তার খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। ছেলেবৌকে তাদের নিজের মত থাকতে দিতে চান তিনি। এমন সময় আবির্ভাব হয় স্ত্রীর এক বান্ধবী অপরাজিতার, যার সাথে ১২ বছর আগে একবার ৪/৫ ঘন্টার জন্য পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু সেই অল্প সময়ের পরিচয়েই দুজনের মধ্যে এক অব্যক্ত সম্পর্ক যেন তৈরি হয়েছিল আজ এত বছর পরেও যা অপরাজিতার কাছে অম্লান হয়ে যায়নি। বান্ধবীর মৃত্যুর পরে তাই কি অপরাজিতা বা অপু নতুন করে কাছে আসতে চাইছে বটকৃষ্ণ রায়ের? কিন্তু আর্মির অবসতপ্রাপ্ত কর্নেল বটু কি চান? কাহিনী আরো এগিয়ে না গেলে তা বোঝার উপায় নেই।

একদিন হঠাৎ বাসায় একটি দূর্ঘটনা ঘটে। গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গ্যাস নির্গত হচ্ছে, বাসায় সবাই ভয় পেয়ে ফ্লাট থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু নিজের ঘর থেকে খুব সাবধানে ধীর স্থির মস্কিষ্কে বটু বাবু বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেন। তিনি কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে স্বাভাবিকভাবে কিচেনে ঢুকে গেলেন, ঘরের প্রতিটি জানালা খুলে দিলেন, সতর্কতার সাথে গ্যাস সিলিন্ডারটি বন্ধ করলেন এবং সেটিকে নিয়ে এলেন বাইরে। ছেলে সঞ্জু এবং বৌমা পিঙ্কির চিৎকারে ইতিমধ্যেই অন্যান্য ফ্লাটের অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সকলেই বটুবাবুর সাহসের প্রশংসা করলেন। পাশাপাশি এমন বিপদের মুহূর্তে বয়স্ক বাবাকে ফেলে তার পুত্র এবং পুত্রবধূ যে পালিয়ে গেছেন-তার সমালোচনা করতেও ছাড়লেন না।

সামগ্রিক ঘটনা-প্রবাহে পিঙ্কি খুবই অপ্রস্তুত এবং অনুতপ্ত হয়ে পড়ে। কাজটা যে আসলেই ঠিক হয়নি তার জন্য স্বশুর মশাইকে তার দোষী মনে হয়, কেননা শ্বশুর মশাইও যদি সকলের সাথে পালিয়ে যেতেন তাহলে অন্যরা এই সমালোচনা করার সুযোগ পেত না। পিঙ্কা হঠাৎ ই শ্বশুর মশাইকে বলে বসে, “আপনাকে আমার একটুও ভালো লাগে না। বটুবাবু বুঝতে পারেন না, পিঙ্কা কেন এমন বলছে।

আপতত দৃষ্টিতে খুব সাধারণ একটি কাহিনী মনে হলেই গল্পের চমক অপেক্ষা করছে শেষ মূহুর্তে। সঞ্জয় বা সাজু এক ভয়ংকর ক্রিমিনালের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই ক্রিমিনাল সঞ্জয়কে বাগে না পেয়ে পিঙ্কিকে ফলো করতে থাকে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় পিঙ্কি, ভয় পেয়ে যায় সঞ্জয়ও। ক্রিমিনালের ভয়ে বাড়িতে সিকিউরিটি মোতায়েন করে সঞ্জয়। কিন্তু সব কিছু শুনে সভাবসুলভ ধীর স্থির বটকৃষ্ণ সঞ্জুকে বলে সিকিউরিটি তুলে নিয়ে ক্রিমিন্যালকে ফ্লাটে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার। পিঙ্কি এবং সঞ্জয় উভয়ই অবাক হয় এমন সিদ্ধান্তে। শেষে তারা মেনে নেয় বটুবাবুর সিদ্ধান্ত এবং সুযোগ পেয়ে ক্রিমিন্যাল প্রবেশ করে বটুবাবুর ফ্লাটে, কিন্তু অসাধারণ দক্ষতায় ক্রিমিন্যালকে সামলে নেন বটুবাবু।

বটকৃষ্ণের এই অবিচল ধৈর্য্য, অদম্য সাহস আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে পিঙ্কি আবিষ্কার করে এক ভয়ংকর সত্যকে, যে সত্যর মানেই এক মহাপাপ!!! কি সেই পাপ? জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে “গুহা মানব” নামের অসামান্য এই বইটি।

পিঙ্কির পাপবোধের অসাধারণ বিশ্লেষণই পাঠককে এক অনাবিল স্বাদ এনে দেয়, পাঠক পরিচিত হয় এক চিরায়ত অথচ নতুন জীবনদর্শনের সাথে। শেষ পর্যন্ত বটুবাবুরই এক চমৎকার সমাধান খুজে দেন পিঙ্কিকে। পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে পিঙ্কির দু’চোখ বেয়ে অঝর ধারায় বারিঝরতে থাকে, বটু বাবুও পুরোপুরো বুঝতে সমর্থ হন তার পুত্রবধূকে। সব মিলিয়ে গল্পের শেষটা অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক এক জীবন আলেখ্য হয়ে অসাধারণ কাহিনীরূপে ধরা পড়ে পাঠকের কাছে। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন