রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলে। কোলকাতার কোন এক জনসভায় তিনি এ নিয়ে
একটি বক্তব্যও দিয়েছিলেন। কিছু মানুষ এমন দাবী করে থাকেন। তাদের এই দাবীর
প্রেক্ষিতে বাংলা ব্লগিং জগতে এটা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে
দেখা গেছে উগ্র জাতীয়তাবোধ এবং মৌলবাদী কিছু মুসলমান কর্তৃক এই জাতীয় লেখা বেশি
প্রচার করা হয়ে থাকে। সংগত কারণেই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার বোঝা যায়।
রবীন্দ্রনাথকে বিতর্কিত করার চেষ্টা ইতিহাসে নতুন নয়। কিন্তু যারা রবীন্দ্রনাথ
পড়েছেন তারা খুব ভালো করেই তাকে বুঝেছেন। না, আমি দুই-একটা ছোটগল্প বা কবিতা পড়ার
কথা বলছি না, রবীন্দ্রনাথকে
বুঝতে হলে, জানতে
হলে পড়তে হবে অনেক বেশি।
যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাকারী হিসাবে প্রমাণ করতে চান তাদের কেউই
রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েননি কিংবা পড়লেও পড়েছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। মূলত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এমন দাবীর কোন
প্রমাণ নেই। ইন্টারনেটে কিছু ব্যক্তিগত ব্লগেই এই জাতীয় কিছু পোস্ট চোখে পড়ে (ঠিক
এই লেখাটির মত), যা
যে কেউ চাইলে যেকোন সময়ে লিখতে পারে।
হাস্যকর একটা ব্যপার হলো, কিছু
মানুষের দাবী আবার এমন-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার একটি কবিতায় বলেছেন, “সাত কোটি
সন্তানেরে, হে
মুগ্ধ জননী, রেখেছ
বাঙালী করে, মানুষ
কর নি।” এখানে তিনি বাঙালিদের অপমান করেছেন। তাদেরকে বলি, ভাই, সম্পূর্ণ
কবিতাটি একবার পড়েন-
বঙ্গমাতা
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে
উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার
সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব
গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না
ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা
স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া
সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের
ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না
ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও
ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের
ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া
লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ
জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর
নি।
এই কবিতাটি যখন লেখা হয় তখন
বাংলাদেশ নামে আলাদা কোন দেশ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমগ্র বাঙালীদের চেতনার
বিকাশ প্রত্যাশা করে কবিতা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও বাঙালী তো এই
কবিতার উদ্দেশ্য যদি হয় বাঙালিদের ছোট করা তাহলে তিনি নিজেও কি ছোট হয়ে যাচ্ছেন না? আসলে এখানে
একটি গভীর দর্শন আছে যা উপলব্দি করতেও গভীর হৃদয়ের মানুষ হতে হয়।
এরপরেও যারা গো গো করছেন
তাদের বলি, রবীন্দ্রনাথ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীরা করলেন এবং প্রতিষ্ঠার মাত্র ৫ বছর পরেই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডেকে আনা হল সেখানে বক্তব্য দেওয়ার জন্য এবং পরে তাকে আবার
ডি.লিট উপাধীও দেওয়া হল---এটা কিভাবে সম্ভব?
তাহলে কারা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন? বিবিসি’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে
উঠে এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর তৎকালীন সময়ে কলকাতার কিছু উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন। কারণ তাদের মনে হয়েছিল ঢাকায়
বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেট কমে যাবে। এরপরও কিছু মানুষ
অবাক হয়ে যেতে পারেন এটা শুনে যে কলকাতার কিছু মুসলমানও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন, কারণ তারা ভেবেছিলেন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতার
মুসলমানদের কোন লাভ নেই। কি আশ্চর্য সকলেই নিজ নিজ লাভের কথাই চিন্তা করছে !!! এবং
এটাই স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন কিনা-এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন জনাব তৌহিদুল হক, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক । তার বক্তব্য, “ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণীর মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন তাদের
মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় কাতারে রাখতে চাই। কারণ তারা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের
উচ্চবর্ণের কিছু হিন্দু সমাজ। তাঁদের সাথে বিশেষ করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে
রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার বৈঠক,আলোচনা হয়েছে শিলাইদহ যাওয়ার আগেও। এ থেকে আমরা অনুধাবন
করতে চাই সেখানে পূর্ববঙ্গের সার্বিক উন্নতি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
তবে এরও কোন স্পষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই"।
শেষের লাইনটি আবার পড়ুন, “তবে এরও কোন
স্পষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই”। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমরা বলছি, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীরা করেছিলেন? এই প্রশ্নের
উত্তর খুজতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের
জন্য হয় ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল পূর্ব-পাকিস্তান। এই পূর্বপাকিস্তানের
শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনের ব্যপারে সরকার এবং সরকারপন্থী কিছু
সংকীর্ণ মনের মানুষ চরম অনীহা প্রকাশ করে। এরপর যখন ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের
মধ্যে যুদ্ধ হয় তখন পাকিস্তান সরকার সরাসরি রবীন্দ্রসংগীতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
কিন্তু যে বাঙালির চেতনার সাথে রবীন্দ্রনাথ মিশে আছে তাকে আলাদা কর কিভাবে সম্ভব? পারেনী
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের যারা পাকিস্তানের পক্ষে
অবস্থান নিয়ে নিরীহ বাঙালী নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল কালের পরিক্রমায় আজ তারাই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এই নিকৃষ্ট অপপ্রচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পর্দার
অন্তরালে থেকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক দীপশিখা যার আলোর কাছে সবকিছুই
ম্লান হতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথকে আজ আমরা কিভাবে স্মরণ করব তাতে তার কিছুই আসে যায়
না কিন্তু বাঙালি হয়েও তাকে হৃদয়ে ধারণ না করতে পারা আমাদেরই মানবতার অবক্ষয়ের
নির্লজ্জ সনপত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।
শেষ করতে চাই ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এপিজে আবুল কালাম
আজদের একটা উক্তি দিয়ে- “তুমি যদি কোরআন পড়, একজন ভালো মুসলমান হতে পারবে, তুমি যদি
গীতা পড়, একজন
ভালো হিন্দু হতে পারবে আর তুমি যদি রবীন্দ্রনাথ পড়, একজন ভালো মানুষ হতে পারবে।”
আফসোস, আমরা বাঙালী
হয়েও রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারলাম না ! !
বি বি সি'র
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটির লিঙ্ক নিচে যুক্ত করা হলঃ
সৌমিত্র বিশ্বাস
কম্পিউটার ডেমোনেস্ট্রেটর
ডুমুরিয়া এনজিসি এ্যান্ড
এনসিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়
ডুমুরিয়া, খুলনা।
মেইলঃ soumittro@gmail.com
মোবাইলঃ +8801717006910
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন