মঙ্গলবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সৌভাগ্যের বিচি (একটি ছোটগল্প)


জাপান সাগরের তীরে ছোট একটি গ্রাম। গ্রামের নাম ফুকুজুকু। এই গ্রামে বাস করে নাকাচুকু নামে একটি ছেলে আর তার মা। ছেলেটি খুব সৎ কিন্তু বড্ড অলস, কিছুই করতে চায় না। ছোটবেলাতেই বাবা মারা যাওয়ার পর নাকাচুকু’র মা ছেলেকে অতি আদরে বুকে আগলে রেখেছেন। নিজে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বড় করে তুলছেন নাকাচুকুকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় নাকাচুকু কোন কাজই করতে চায় না। মায়ের খুব দুঃখ হয় তার অবর্তমানে ছেলের কি হবে তাই ভেবে। এভাবে দিন যায়, একদিন নাকাচুকুর মা খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করে মা নাকাচুকুকে কাছে ডাকলেন তারপর হাতে ছোট একটি শুকনো বিচি দিয়ে বললেন বাবা নাকাচুকু আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচব না। আমার মৃত্যুর পর তুমি এই বিচিটি গ্রামের শেষ প্রান্তে যে পাহাড় আছে তার শীর্ষে পুতে দেবে। এটি তোমার সৌভাগ্য বয়ে আনবে। 

কয়েকদিন পর নাকাচুকুর মা মারা গেল। মায়ের মৃত্যুর পর নাকাচুকু কয়েকদিন অসহায়ভাবে কাটালো, তারপর একদিন মায়ের দেওয়া সেই বিচিটি নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে গেল। একটা উপযুক্ত জায়গা দেখে নাকাচুকু বিচিটি পুতে দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসল। একদিন পর বিকেলে আবার নাকাচুকু সেই পাহাড়ের উপরে গিয়ে দেখতে পেল যেখানে সে বিচিটি পুতেছিল সেখানে এক ফুটের মত একটি গাছ এবং গাছে চমৎকার একটি ফুল। নাকাচুকু রীতিমত অবাক হয়ে গেল। নাকাচুকু আরো অবাক হয়ে দেখল ফুলের উপর একটি বড় প্রজাপতি বসে আছে। মাত্র একদিনেই এমন একটি অদ্ভুত ফুল গাছের জন্ম হতে দেখে নাকাচুকু মনে মনে ভাবল এটা নিশ্চয়ই তার জন্য কোন সৌভাগ্য বয়ে আনবে। সে খুব আনন্দি হয়ে বাড়িতে ফিরে আসল এবং পরদিন আবার পাহাড়ের উপরে উঠে দেখল গাছে আর কোন পরিবর্তন হয়নি। এরপর থেকে প্রতিদিন নাকাচুকু পাহাড়ে উঠতে থাকল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গাছ আর মোটেই বৃদ্ধি পেল না।
প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন দেখা গেল যে, গাছ বড় হল না এবং সেই একটিমাত্র ফুল আর ফুলকে ঘিরে একটি প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে তখন নাকচুকুর কিছুটা রাগ হল। সে ভাবল হয়তো এই গাছ থেকে কিছুই হবে না। সে গাছের মাঝ থেকে ভেঙ্গে ফুলসহ গাছটি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসল। পাহাড় থেকে নেমে সে দেখল একটি ছোট্ট মেয়ে ও তার বাবা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটি নাকাচুকুর হাতে ফুল ও ফুলের উপর রঙ্গীন ডানার সুন্দর প্রজাপতি দেখে তার বাবার কাছে বায়না ধরল ফুল ও প্রজাপতিটি নিয়ে তাকে দেওয়ার জন্য। লোকটি তখন নাকাচুকুকে অনুরোধ করলেন ফুল ও প্রজাপতিটি তার মেয়েকে দেওয়ার জন্য এবং বিনিময়ে তিনি নাকাচুকুকে তিনটি বড় বড় কমলালেবু দিলেন। নাকাচুকু কমলালেবু পেয়ে খুশি হয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল।
তখন গরমের সময়, চারিদিকে প্রচন্ড তাপ। এই গরমের মধ্যে একজন তাঁতী কিছু কাপড় বিক্রির জন্য পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রচন্ড গরমে এবং মাথায় ভারী বোঝা থাকায় তাঁতী হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। নাকাচুকু আশেপাশে কোন লোকজন দেখতে না পেয়ে নিজের কমলালেবু তিনিটির রস আস্তে আস্তে তাঁতীকে খাইয়ে দিলেন। এতে তাঁতী সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠলেন এবং প্রতিদানস্বরূপ তাঁতী নাকাচুকুকে তার বোঝা থেকে একখানা চমৎকার কাপড় উপহার দিলেন। নাকাচুকু শাড়িখানা নিয়ে আবার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। গ্রামে প্রবেশের পর নাকাচুকু দেখতে পেলেন গ্রামের জমিদারের একমাত্র মেয়ে রুকুসুকু গাড়িতে করে কোথায় যাচ্ছে।
নাকাচুকু মনে মনে জমিদারের মেয়েকে পছন্দ করত সে তাঁতীর কাছ থেকে পাওয়া শাড়িটি রুকুসুকুকে উপহার দিল। রুকুসুকু শাড়িটি পেয়ে খুব খুশি হয়ে নাকাচুকুকে বলল সে যেন পরদিন তার বাবার সাথে দেখা করে। রুকুসুকু ভেবেছিল যেহেতু নাকাচুকু গরীব তাই বাবাকে বলে দেবে তাকে কিছু টাকা দেওয়ার জন্য।
পরদিন নাকাচুকু জমিদার বাড়িতে হাজির হল। জমিদার ছিল ভীষণ কৃপণ। সে নাকাচুকুকে ঠকানোর মতলব করল। নাকাচুকুকে সে একটা পলা (একখন্ড নলাকার লোহার টুকরো যা জালে ব্যবহার করা হয়) নাকাচুকুর হাতে দিয়ে বলল এটা কোন সাধারণ পলা নয় এটা সৌভাগ্যের পলা, এটা কাছে রাখলে মানুষ সহজেই ধনী হয়ে যায়। নাকাচুকু সরল মনে সেটা বিশ্বাস করল এবং পলাটি পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।
ঐদিন বিকেলে সে যখন নদীর তীরে বেড়াতে গেল তখন পাকাচুকু নামে এক জেলে নদীতে মাছে ধরতে এলো। পাকাচুকু জাল বের করে নদীতে ফেলতে গিয়ে দেখল তার জালের একটা পলা ছিড়ে গেছে। পাকাচুকুর খুব দুঃখ হল কেননা এই অবস্থায় নদীতে জাল ফেললে জালের ঐ অংশ দিয়ে মাছ পালিয়ে যাবে। নাকাচুকু জেলের এই দুঃখ দেখে পকেট থেকে জালের সেই পলাটা বের করে তাকে দিয়ে দিলো। পাকাচুকু খুশি হয়ে পলাটি জালে লাগিয়ে মাছ ধরা শুরু করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনেকগুলো মাছ পেয়ে গেল। মাছগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে বড় মাছটি সে নাকাচুকুকে দিয়ে দিল পলাটির বিনিময়ে। নাকাচুকু খুশি হয়ে বাড়িতে ফিরে মাছ কাটতে বসল। মাছ কাটার সময় তার পেট থেকে একটা বড় সাইজের হীরের টুকরো বের হল।
নাকাচুকুর তখন আনন্দের সীমা রইল না, সে পরদিন সকালেই সে হীরার টুকরোটি বিক্রির জন্য শহরে গিয়ে পৌছালো। শহরের বণিকগণ নাকাচুকুর হীরা থেকে অবাক হল, তারা জীবনেও এত বড় হীরা দেখেনি। শেষ পর্যন্ত দেশের রাজা স্বয়ং হীরাটি অনেক অর্থের বিনিময়ে কিনে নিলেন। নাকাচুকু অনেক বড়লোক হয়ে গেল। সে গ্রামে ফিরে এসে সুন্দর একটি বাড়ি বানিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করল। গ্রামের লোকজন যখন তার কাছে জানতে চাইল সে এত টাকা কোথায় পেল নাকাচুকু তখন তার মায়ের দেওয়া সেই অজানা গাছের বিচির থেকে কিভাবে ফুল-প্রজাপতি, কমলালেবু, শাড়ি,জালের পলা এবং শেষে মাছের পেটে হীরার টুকরো পেয়েছে সেই গল্প বলল।
জমিদার তখন নাকাচুকুর তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। তখন নাকাচুকু রুকুসুকুকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। 
---------- গল্পটি একটি জাপানী গল্প ও একটি আরবীয় রূপকথার সংমিশ্রণের ছায়া অবলম্বণে রচিত। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন