ঋষি গৌতমের স্ত্রী। ব্রহ্মা এক পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্টির মানসে অন্যান্য জীবের শ্রেষ্ঠ অঙ্গসমূহ নিয়ে অহল্যাকে সৃষ্টি করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর সতীত্ব হরণ করেন, ব্যভিচারের অপরাধে ঋষি গৌতম তাঁকে অভিশাপ দেন এবং পরবর্তীতে বিষ্ণুর অবতার রাম এসে তাঁকে শাপমুক্ত করেন।
রামায়ণের উত্তর কাণ্ডে বলা হয়েছে, প্রজা সৃষ্টির পর সেই প্রজাদের বিশিষ্ট প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্রহ্মা এক কন্যা সৃষ্টি করেন। অদ্বিতীয়া সুন্দরী ও সত্যপরায়ণা বলে ব্রহ্মা তার নাম রাখেন অহল্যা। এই সুন্দরী কন্যাটিকে ব্ৰহ্মা ঋষি গৌতমের নিকট নিকট ‘ন্যাসভূতা’ অর্থাৎ গচ্ছিত রেখেছিলেন। ইন্দ্র অহল্যার অপরূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহের বাসনা করেন। কিন্তু বহু বছর পরে গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার নিকট ফিরিয়ে দিলে, ব্ৰহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে অহল্যার সাথেই গৌতমের বিবাহ দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্র অহল্যাকে ছলনা করে ধর্ষণ করেছিলেন। এই কারণে, গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে যুদ্ধে তাকেও ধর্ষিত হতে হবে এবং যে ধর্ষণ প্রথার সূচনা জগতে ইন্দ্র করলেন তার অর্ধেক পাপ তাকেই বহন করতে হবে এবং জগতে দেবরাজের স্থানও স্থাবর হবে না। পুনশ্চ, তাকে অণ্ডকোষহীন হয়ে থাকতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই শাপের ফলে ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে লঙ্কায় বন্দী করে আনেন ও নির্যাতন করেন। গৌতম অহল্যাকেও শাপ দেন, “মামা সমীপতঃ বিনিধ্বংস"; এবং অহল্যা অপেক্ষাও অধিক সুন্দরী পৃথিবীতে তার রূপের গৌরব খর্ব করতে জন্মগ্রহণ করবেন। অভিশাপ শুনে অহল্যা স্বামীকে বােঝান যে, ইন্দ্ৰ গৌতমের রূপ ধারণ করে তাকে ধর্ষণ করেছেন, এখানে অহল্যার কোন দোষ নেই। গৌতম তখন শান্ত হন এবং শাপমুক্তির উপায় বলে দেন। তিনি বলেন, রামের দর্শনে অহল্যা আবার পবিত্র হবেন। গৌতম এরপর নিজের আশ্রমে ফিরে যান ও অহল্যা তপস্যা করতে থাকেন।
রামায়ণের আদিকাণ্ডেই আবার এই উপাখ্যানটি সামান্য অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই উপাখ্যানে বলা হয়েছে, মিথিলার নিকটস্থ এক উপবনে নিজের আশ্রমে গৌতম অহল্যাকে নিয়ে বাস করতেন। একদিন মুনির অনুপস্থিতির সুযােগে, তার বেশ ধরে এসে ইন্দ্র অহল্যার নিকট সঙ্গম প্রার্থনা করেন। পূজারত অহল্যা তাকে প্রতীক্ষা করতে বললেও, তার শাপের ভয়ে মিলনে রাজি হন। অহল্যার সাথে যৌন মিলন করার পর ইন্দ্র পালাতে যান। পালাতে গিয়ে ইন্দ্র ধরা পড়ে যান। গৌতম স্নান করে তখন সমিধকুশ নিয়ে ফিরছিলেন। ইন্দ্রকে তিনি অভিশাপ দেন যে তাকে বৃষণ অর্থাৎ অণ্ডকোষহীন হতে হবে। অহল্যাকে তিনি শাপ দেন যে তাকে বহু সহস্র বছর “বায়ুভক্ষা, নিরাহারা, ভস্মশায়িনী, তপতী, প্রস্তরবৎ ও অদৃশ্যা” হয়ে থাকতে হবে। রাম তাকে আতিথ্য দিলে তিনি পবিত্র হবে ও কামরহিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবেন। এরপর গৌতম হিমবৎ পর্বতের শিখরে তপস্যায় নিমগ্ন হন। মিথিলার পথে এই উপাখ্যান শুনতে শুনতে রাম ও লক্ষ্মণ মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। অহল্যার শাপমুক্তি ঘটে। তিনি ভস্মশয্যা থেকে উঠে এসে অতিথি সৎকার করেন। রাম ও লক্ষ্মণও তার পদধূলি নেন। দেবতারা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি ঘটান ও অহল্যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। গৌতম ঋষি ফিরে আসেন এবং রামচন্দ্রকে পূজা করে স্ত্রীকে নিয়ে তপস্যা করতে চলে যান।
কথাসরিৎসাগর এ আবার বলা হয়েছে, ইন্দ্র ধরা পড়েননি। তিনি ‘মার্জার’ অর্থাৎ বিড়ালের এর রূপ ধারণ করে পালিয়ে যান। গৌতম স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘মার্জার’ চলে গেছে। কথাটি দ্ব্যর্থক। এক অর্থে ‘মৎ-জার’ অর্থাৎ আমার নিষিদ্ধ প্রেমিক, অন্য অর্থে বিড়াল।
একটি মতে, গৌতমের অভিশাপে অহল্যা পাথর হয়ে যান। রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে তার মুক্তি ঘটে। অন্য একটি মতে, গৌতমের শাপে ইন্দ্রে সারা দেহ যোনি চিহ্নে ভরে যায়। পরে ইন্দ্রের কাতর প্রার্থনায়, সমস্ত যোনি-চিহ্ন গুলি চোখে (লোচন) রূপান্তরিত করে দেন। ইন্দ্র সহস্র-লোচন হয়ে বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেলেন। একটি মতে, অহল্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র মোরগের বেশে মধ্যরাতে আশ্রমে উপস্থিত হন ও ডেকে ওঠেন। ভোর হয়েছে মনে করে ঋষি স্নানে চলে যান। ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশে ফিরে এসে অহল্যাকে সম্ভোগ করেন। আবার অন্য একটি মতে জানা যায়, শাপমোচনের পর গৌতম পুত্র শতানন্দকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এসেছিলেন এবং একসঙ্গে বসবাসও শুরু করেন। পদ্মপুরাণেও রামের পাদস্পর্শে অহল্যার মুক্তির কথা আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন