শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০২২

পরশুরাম কাহিনী




প্রাচীনকালে কান্যকুজ নামক দেশে গাধি নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর সত্যবতী নামে এক কন্যা ছিলো। সেকালে ঋষিরা রাজকন্যা বিবাহ করতেন। মহর্ষি ভৃগুর পুত্র ঋচীক এই কন্যাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে রাজার কাছে গেলেন। ঋচীক বললেন, “মহারাজ, যদি ঋষিকে কন্যাদান করতে আপত্তি না থাকে— তা হলে আমি আপনার কন্যাকে প্রার্থনা করি।” 
গাধি বললেন- “হে তপােধন, আপনাকে কন্যা দান করতে আমার কোন আপত্তি নেই। আপনার ন্যায় মহাতপা ঋষিকে জামাতা রূপে লাভ করলে আমি সৌভাগ্যই মনে করব। তবে আমাদের একটি কৌলিক প্রথা আছে। আমাদের রাজবংশে কন্যা গ্রহণ করতে হলে এক সহস্র অশ্ব আপনাকে দিতে হবে।” 
ঋচীক বললেন- “আমি ঋষি, এত অশ্ব কোথায় পাব? কিন্তু বিনা পণেও আমি বিবাহ করতে চাই না। আপনি আমাকে ছয়মাস সময় দিন।” 
মহারাজ গাধি সম্মত হলেন। 
ঋচীক বরুণের নিকট সহস্র অশ্ব প্রার্থনা করলেন। বরুণ তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে এক সহস্র অশ্ব দান করলেন। ঋচীক এক মাসের মধ্যেই অশ্ব নিয়ে উপস্থিত। একমাত্র অপূর্ব রূপবতী কন্যাকে তপস্বীর হস্তে দান করার ইচ্ছা বােধ হয় গাধির ছিল না। 
সেজন্য এক সহস্র অশ্ব কন্যাপণ চেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন একজন তপস্বী একটা ঘােড়াই যােগাড় করতে পারবে না। ঋষিকে রাজা ভয়ও করতেন খুব, সাহস করে প্রত্যাখ্যান করতেও পারেন না- যদি অভিশাপ দিয়ে বসেন। তাই বােধ হয় ঐ ভাবে এড়াইতে চেয়েছিলেন। অনেক রাজাই অভিশাপের ভয়ে তপস্বীর হতে কন্যাদান করতেন। এক সহস্র অশ্ব নিয়ে যখন ঋষি উপস্থিত, তখন গাধির আর কন্যাদান করা ছাড়া উপায় থাকল না। 
ঋচীক সত্যবতীকে বিবাহ করে তপোবনে ফিরে আসলেন। পিতা ভৃগু এ কথা জানতে পেরে আসলেন পুত্র ও পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করতে। সত্যবতী শ্বশুরের সেবা করলেন ভক্তিভরে। ভৃগু বললেন- “বৎসে, তুমি বর প্রার্থনা কর।” 
সত্যবতী বললেন, “তাত, যদি দয়া করে বর দান করেন তবে আমায় পুত্ৰবর দিন। আর আমার জননীর আজও কোন পুত্র হয় নি, তারও একটি পুত্র হােক।” 
ভৃগু বললেন, “আমি যজ্ঞ করে যে চরু দেবতাকে উৎসর্গ করব তার অর্ধেক অংশ তুমি ডুমুর গাছকে আলিঙ্গন করে খাবে, আর অশ্বত্থ গাছকে আলিঙ্গন করে যেন তােমার মা চরুর দ্বিতীয় অর্থ খান।” 
যজ্ঞের পর চরু লইয়া সত্যবতী পিতৃগৃহে চলে গেলেন। কিন্তু সত্যবতী ভুল করে অশ্বথগাছকে আর তার মা ডুমুর গাছকে আলিঙ্গন করে চরু ভক্ষণ করলেন। 
ভৃগু যখন এই ভুলের কথা জানতে পারলেন তখন বললেন, “তােমার গর্ভে যে সন্তান হবে, সে ঋষি হয়েও হবে স্বভাবে ক্ষত্রিয়, আর তােমার মা’র গর্ভে ক্ষত্রিয় বীরের জন্ম হলেও সে হবে ঋষি।” 
সত্যবতী বললেন, “তাত, আমার পুত্র যেন স্বভাবে ক্ষত্রিয় না হয়, পৌত্র যেন স্বভাবে ক্ষত্রিয় হয়।” 
ভৃগু  বললেন, “তথাস্তু।” 
যথাকালে সত্যবতীর এক পুত্রের জন্ম হল। এই পুত্রের নাম জমদগ্নি। ক্রমে জমদগ্নি উগ্রতপা ঋষি হয়ে উঠিলেন। তিনি ইক্ষাকুবংশীয় নৃপতি প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকাকে বিবাহ করলেন। রেণুকার গর্ভে জমদগ্নির চারপুত্রের জন্ম হল। তাহাদের এক জনের নাম রাম। 
একসময় জমদগ্নি রেণুকার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে পুত্রদের মা কে হত্যার নির্দেশ দিলেন। তিন পুত্র সম্মত হলেন না। কিন্তু রাম মা কে হত্যা হত্যা করে পিতার আদেশ পালন করলেন। জমদগ্নি তিন পুত্রকে অভিশাপ দিলেন “তােমরা জড়বুদ্ধি হয়ে থাকো।” অন্যদিকে রামকে বললেন, “তুমি যা ইচ্ছা বর প্রার্থনা করো।” রাম বললেন, “তাত, যদি বরদান করেন, তবে আমার মা পুনর্জীবন লাভ করুক, আর আমার ভাইরা তাঁদের বােধশক্তি ফিরে পেয়ে দীর্ঘজীবী ও মহাজ্ঞানী হয়ে উঠুক। আর মাতৃহত্যার পাপ যেন আমাকে স্পর্শ না করে।” 
জমদগ্নি পরশুরামকে এই বর দিলেন। পরশু দ্বারা মাতৃহত্যা করার জন্য রামের নাম হ’ল পরশুরাম। এই পরশুরাম সত্যবতীর পৌত্র, স্বভাবে ক্ষত্রিয়। আর সত্যবতীর যে ভ্রাতটির জন্ম হয়েছিল, তিনিই বিশ্বামিত্র। তিনি ক্ষত্রিয় হয়েও পরবর্তী জীবনে ঋষি হয়েছিলেন। 
একবার চন্দ্রবংশীয় হৈহয় রাজা কৃতবীর্যের পুত্র অর্জুন মৃগয়া করতে গিয়ে জমদগ্নির আশ্রমে অতিথি হন। জমদগ্নি তার হােমধেনু কপিলার সাহায্যে অৰ্জ্জুন ও তাঁর বহুশত, অনুচরকে ভূরিভােজনে আপ্যায়িত করলেন। যাওয়ার সময় রাজা ঋষির কপিলাটিকে চাইলেন। জমদগ্নি তা দিতে সম্মত হলেন না, বললেন,“মহারাজ, আপনার ঐশ্বর্যের অভাব কি? আমি বনবাসী ঋষি, আমার আর কোন সম্পদ নেই। এই হােমধেনুটি হারালে আমার যাগযজ্ঞ সব বন্ধ হয়ে যাবে।” 
অর্জুন বললেন, “মহর্ষি, আমি আপনাকে সহস্র গাভী দেব, আপনি এই ধেনুটি আমাকে দিন।” 
ঋষি বলিলেন, “আমি সহস্র গাভী নিয়ে কি করে পালন করব, মহারাজ? আমার কপিলাটি গ্রহণ করবেন না। এ কপিলা নিয়ে গিয়ে আপনার কোন লাভ হবে না। আমার আশ্ৰম হ’তে চলে গেলে কপিলা ধনরত্ন, খাদ্যপানীয় কিছুই প্রসব করবে না, এক বিন্দু দুধও দেবে না।” 
মহারাজ অর্জুনের দুর্মতি হল। তিনি কিছুতেই শুনলেন না। কপিলাকে জোর করে নিয়ে গেলেন। পরশুরাম তখন আশ্রমে ছিলেন না। তিনি আশ্রমে আসার পর সব কথা শুনে অর্জুনের নর্মদাতীরের রাজধানীতে উপস্থিত হলেন। পরশুরাম অর্জুনকে যুদ্ধে আহবান করলেন। অর্জুনের ছিল এক হাজার হাত। এক হাজার হাতে হাজার রকমের অস্ত্র ধরে তিনি যুদ্ধ করিতে আসলেন। পরশুরাম তাঁর কুঠারের দ্বারা অর্জুনের হাতগুলি একে একে কাটিয়া শেষে মুশুটি কেটে ফেললেন এবং অর্জুনের সৈন্যসামন্তদের বধ করে হােমধেনু কপিলাকে তপােবনে ফিরিয়ে আনলেন। 
পরবর্তীতে অর্জুনের পুত্রেরা একদিন জমদগ্নির আশ্রমে গিয়ে জমদগ্নিকে একা পেয়ে বধ করে প্রতিহিংসা চরিত্রার্থ করল। পরশুরাম ফিরে এসে পিতার ছিন্নমুণ্ড দেহ দেখে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “পৃথিবীতে একজন ক্ষত্রিয়কেও জীবিত রাখব না, আমি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করব।” 
জননী রেণুকা পতির চিতায় আরােহণ করে সহমরণে গেলেন। সহমরণের আগে পরশুরামকে ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করিতে নিষেধ করলেন। তিনি বলিলেন, -“ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস পেলে এই ভারতবর্ষকে কে রক্ষা করবে? সমগ্ৰদেশ বন্য বর্বরদের হাতে চলে যাবে। ঋষিদেরই বা কে রক্ষা করবে? অরাজক দেশে মানুষ বাস করতে পারবে না।” 
পরশুরাম মায়ের আদেশ শুনলেন না। তিনি একে একে সকল রাজা, রাজন্য ও ক্ষত্রিয়দের বধ করিতে লাগিলেন। একবারে ক্ষত্রিয়কুল নির্মূল হতে পারে না। অনেকেই লুকিয়ে বেঁচে রইলেন, অনেক ক্ষত্রিয়সন্তান ক্ষত্ৰনারীদের গর্ভে থেকে গেল। একে একে পরশুরাম একুশ বার ক্ষত্রিয়কুল ধবংস করলেন। 
পরশুরামের গুরু ছিলেন শিব। একবার শিবের সঙ্গে অসময়ে দেখা করবার জন্য তিনি কৈলাসে যান। শিবের আশ্রমের দ্বারে গণেশ ছিলেন প্রহরী। গণেশ পরশুরামকে বাধা দেন, পরশুরাম রেগে গিয়ে গণেশের একটা দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। 
একদিন পরশুরামের পিতামহ ঋচীক পরশুরামের কাছে গিয়ে বলিলেন, “বৎস, তুমি আর ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস কোরাে না, তারা এখন শান্তশিষ্ট ভাবে ধর্মপথে থেকে প্রজাপালন করছে, তারা ঋষিদের উপর অত্যাচার করে না, বরং ঋষিদের তপ-জপ যাগযজ্ঞ সমস্তই রক্ষা করছে- তপােবনের কাছে রাক্ষসদেরও আসতে দেয় না। তুমি আর তাদের উপর নিষ্ঠুর হয় না।” 
পিতামহের কথায় পরশুরাম এক মহাযজ্ঞ করে পৃথিবীর আধিপত্য কশ্যপকে দান করিলেন। তারপর তপস্যার জন্য মহেন্দ্র পর্বতে চলে গেলেন। 
অনেককাল পরের কথা। রামচন্দ্ৰ জনকরাজার গৃহে হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করে মিথিলা হতে অযযাধ্যায় ফিরে যাচ্ছিলেন। পরশুরাম তাঁর গুরু শিবের ধনু রামচন্দ্ৰ ভেঙ্গেছেন শুনে মহেন্দ্ৰপৰ্বত হতে এসে রামচন্দ্রের পথ রোধ করলেন। দশরথ ভয় পেয়ে পরশুরামের চরণতলে পড়ে বললেন, “হে মহর্ষি, বারবার ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করে সমস্ত পৃথিবীর আধিপত্য কশ্যপকে দান করে মহেন্দ্ৰপৰ্বতে তপস্যা করছেন। আপনি ত আর ক্ষত্রিয় ধ্বংস করবেন না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আবার কেন এই বালক বধ করতে এসেছেন? আমাকে বধ করুন। বালক রামচন্দ্রকে অব্যাহতি দিন।” 
পরশুরাম দশরথের কথায় কর্ণপাত না করে রামচন্দ্রকে বললেন, “তুমি আমার নাম গ্রহণ করেছ এত বড় তােমার স্পর্ধা! তুমি হরধনু ভেঙেছ, তুমি আমার হাতের এই হরিধনুতে শর যােজনা কর দেখি।” 
রামচন্দ্র পরশুরামের হাত থেকে বিষ্ণুধনু নিয়ে অবলীলাক্রমে তাতে শরযােজনা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পরশুরামের দেহ থেকে বিষ্ণুতেজ রামচন্দ্রের দেহে চএ গেল। পরশুরাম নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। রামচন্দ্র বললেন, “এ শর নিক্ষেপ করে আমি আপনার কোন্ পথ রুদ্ধ করব, বলুন।” 
পরশুরাম বললেন, “রাম, আমাকে মহেন্দ্ৰপৰ্বতে ফিরে যেতে দাও, তুমি আমার পরলােকের পথ রােধ করতে চাও, কর’। আমার কাজ শেষ হয়েছে, আমি এইবার যােগবলে দেহত্যাগ করব। যে তেজ আমার দেহে ছিল- তা তুমি আকর্ষণ করে নিয়েছ। আমি এখন সামান্য একটা মানুষ মাত্র।” 
এই কথা বলে, পরশুরাম বিদায় নিলেন। এরপর আর কোন পুরাণে পরশুরামের দেখা পাওয়া যায় না। 
[মহাভারত, রামায়ণ, অগ্নিপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ভাগবত ইত্যাদি পুরাণে পরশুরামের কাহিনী আছে।] 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন