এই উপন্যাস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রথমেই আমার যেটা মনে হয়েছে, বইটার নাম চাপরাশ না হয়ে চাপাবাজ কিংবা চাপাবাজি হলে মানত ভালো। কেননা গল্পের শুরু থেকেই হিন্দু সন্ন্যাসীদের এমন সব অলৌকিক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা করা হয়েছে যার পুরোটা আমার কাছে স্রেফ চাপাবাজি ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। এসব সাধু সন্ন্যাসীরা আবার ভালো মানের ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। সাহিত্য, সঙ্গীত এমনি কি অর্থনীতির জটিল সব টার্ম সম্পর্কেও জ্ঞান রাখেন। করো করো আবার বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী রয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব সাধুরা আপনার সাথে কথা না বলেও আপনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন কিংবা আপনার অতীত সম্পর্কে মন্তব্য করেন যা শুনে আপনি বিস্মিত হবেন। মোটকথা লেখক ইনিয়ে বিনিয়ে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, আপনি যতই জ্ঞানী হোন না কেন, আপনি যতই সম্পদশালী হন না কেন এইসব সাধুরা আপনার চেয়ে বেশি জ্ঞানী, জীবনের গভীরতম অর্থ তারা উপলব্ধি করে ফেলেছেন। এমনকি তারা শারীরিক কষ্টকেও জয় করে ফেলেছেন। তীব্র শীতে তারা কষ্ট পান না, কোন খাবার গ্রহণ না করে কাটিয়ে দেন দীর্ঘদিন।
এইসব ব্যাপারগুলো আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। তাছাড়া আমার মনে হয়েছে গল্পের কাহিনীকে অহেতুক টেনে লম্বা করা হয়েছে। শেষ দিকে আমি পড়ার ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারিনি। অবশ্য এটা হয়তো আমার নিজেরই দুর্বলতা। তবে যে কথা দুই লাইনে বলা সম্ভব তা বলার জন্য দশ পৃষ্ঠা ব্যয় করাটা নিছক বাচালতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই চরণ চ্যাটার্জি নামে এক যুবক অর্থ, মান যশের অধিকারী হয়েও হতাশ হয়ে, জীবনের মানে খুঁজতে গোপনে চলে যান তীর্থস্থান হৃষীকেশে। এখানে তার সাথে পরিচয় হয় ভীমগিরি নামে এক সন্নাসীর সাথে। এই ভীমগিরি আবার ধিয়ানগিরি নামে এক মহারাজের শিষ্য। প্রথম দিকে এসব সন্নাসীদের সম্পর্কে চরণের একটা অবজ্ঞা ছিল কিন্তু তাদের বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকাণ্ডের সাথে পরিচয় হওয়ার সাথে সাথে তাদের সম্পর্কে আগ্রহ বাড়তে থাকে। এরপর যেসব সন্নাসীদের সাথে তার পরিচয় হতে থাকে তারা যে বাইরে থেকে খুব সাধারণ মনে হলেও ভিতরে ভিতরে অসাধারণ তা বোঝানোর জন্য লেখকের প্রচেষ্টার কোন অভাব ছিল না।
চরণের এরপর দেখা হয়ে যায় পাটনের সাথে। পাটন চরণেরই এক ক্লায়েন্টের উচ্চ শিক্ষিত বিদেশ ফেরত ছেলে। আমেরিকার বিলাসী জীবন ছেড়ে পাটন গেরুয়া ধারণ করেছে, এসবের ভেতরেই সে খুজে পেয়েছে জীবনের প্রকৃত মানে। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি পাটনের মায়ের সাথে চরণের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এই পাটনই এক পর্যায়ে চরণের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পদে পদে চরণ দেখতে পায় পাটন ইংরেজি সাহিত্য, অর্থনীতি, সঙ্গীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। ভারত তথা হিন্দুদের যে এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস আছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে প্রাচীন ভারতের বিশাল অবদান ছিল তা নানাভাবে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করা হয় এই পর্যায়ে।
এরপর কাহিনীতে আবির্ভাব ঘটে চন্দ্রবদনী নামে এক নারী চরিত্রের। এক কথায় রূপে, গুণে অনন্যা এই চন্দ্রবদনীর প্রতি তীব্র এবং রহস্যময় এক আকর্ষণ তৈরি হয় চরণের। যেমন হঠাৎ করে আবির্ভাব হয়েছি শেষ দিকে তেমনি আবার হঠাৎ করে হারিয়ে যায় চন্দ্রবদনী। চরণ চ্যাটার্জীও ফিরে যায় তার ইট পাথরের নগরীতে। কিন্তু তীর্থস্থানে কাটানো কয়েকমাস তার জীবনবোধকে পালটে দিয়েছে। আমাদের জীবনে ধর্মের প্রয়োজন কেন? জীবনের উদ্দেশ্য কী ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় চরণ। এমনটিই বোঝানো হয়েছে উপন্যাসটিতে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে- এই উপন্যাসের কাহিনী অহেতুক টেনে টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপন্যাসের উদ্দেশ্য সম্ভবত পাঠককে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করা কিন্তু কেন পাঠক ধর্ম চর্চার মাঝে জীবনের স্বার্থকতা খুঁজবে তার সঠিক কোন কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি।
0 মন্তব্যসমূহ