কোন এক ঝড়বৃষ্টির রাত। একজন মুসলিম পথিক স্থানীয় পাল মশাইদের কালি মন্দিরের ছোট্ট বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ঝড়ের গতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পথিক বৃষ্টির তোড়ে বাধ্য হয়ে মন্দিরের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে।
বৃষ্টিভেজা রাতে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাল মশাই ঘুমিয়ে পড়েছে। হটাৎ ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছে; কালী দেবতা তাকে বলছে - "ওরে মূর্খ পাল, তুই মন্দিরে মুসলমান বসিয়ে রেখেছিস! অচিরেই তোর সর্বনাশ হবে!"
পাল মশাই ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে মন্দিরের কাছে গিয়ে দেখলো- ভিতরে একজন লোক বৃষ্টিতে ভিজে জড়সড় হয়ে বসে আছে। সে লোকটাকে মন্দির থেকে বের হয়ে যেতে বললো। কিন্তু লোকটা অনেক অনুনয় বিনয় করে ঝড়বৃষ্টির কথা বিবেচনায় রাতটুকু বারান্দায় থাকায় অনুমতি চাইলো।
পাল মশাই সাদামাটা মানুষ; লোকটার কষ্টের কথা ভেবে লোকটাকে বারান্দায় থাকার অনুমতি দিলো। তবে শর্ত থাকলো: কোন মতেই মন্দিরের ভিতরে ঢোকা চলবে না। এই বলে সে আবার ঘুমোতে গেলো।
একটু ঘুম আসতেই আবার স্বপ্নে সেই দেবতা! - "ওরে নির্বোধ পাল, তুই আবারও আমার মন্দিরে অজাত ঢুকিয়ে সর্বনাশ করলি! অচিরেই তুই ধ্বংস হবি!
পাল মশাই ভয় পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে কেটে স্বপ্নের মধ্যে বলছে - "ঠাকুর, আমি শুধু তোমার ভক্তিতে, শুধু তোমার আরাধনায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছি ঠাকুর। গরীব মানুষ; আমারে এই অভিশাপ দিওনা ঠাকুর।"
ঘুমের ঘোরে এলোমেলো কথা বলতে শুনে পাল মশাইয়ের বউতো ভয়ে কাতর! হুড়মুড় করে উঠে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে আবারও যেয়ে দেখে লোকটা সত্যিই মন্দিরের ভিতরে প্রতিমার কাছাকাছি বসে আছে। এবার সে রেগেমেগে অস্থির হয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই লোকটাকে বের করে দিলো!
অগত্যা লোকটা পাশে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলো আর ভাবতে লাগলো; আমিতো কোন ক্ষতি বা চুরি-চামারি করিনি! তা হলে এই গভীর রাতে কেনো এহেন আচরণ! সে সাহস করে বললো- বাবু, এই দুর্যোগে আমার সাথে কেন এমন করছেন! আমি তো কোন অন্যায় করিনি। ঝড়বৃষ্টির কারনে বাধ্য হয়ে মন্দিরের ভিতরে গিয়েছি। সকাল হলে আমিতো চলে যাবো।
পাল মশাই রাগত স্বরে বললো- "তোমার জন্য আমরা কি সর্বনাশ ডেকে আনবো!" বারবার দেবতারা আমারে স্বপ্ন দেখাচ্ছে; আমার সর্বনাশ হবে। গাছতলাতেও তুমি দাড়াতে পারবেনা। মন্দিরের ত্রিসীমানা থেকে তুমি দুর হও।"
এই কথা শুনে পথিক খুব মনকষ্টে ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়লো। এইবার নিশ্চিত হয়ে পাল মশাই ঘরে গেলো।
এদিকে বেচারা পথিক আশ্রয় হারিয়ে কষ্ট আর রাগে ভাবতে লাগলো- 'বিপদেও ধর্মশালায় আশ্রয় হবেনা!' সে জিদ ধরে আবারও মন্দিরে ফিরে এলো। এবার সে শুকনো খড়কুটো বিছিয়ে একেবারে আসন গেড়ে প্রতিমার গায়ে হেলান দিয়ে বসলো!
বারবার ঘুমে বিঘ্ন ঘটায় এবার পাল মশাইয়ের নাক ডাকা ঘুম; কিন্তু আবারও সেই স্বপ্ন! এবার দেবতা ঠাকুর বলছে - "আর সহ্য করবো না! তুই আবারও আমার মন্দিরে বিধর্মী ঢুকিয়েছিস! তাও আবার আমার গায়ের উপর হেলান দিয়ে শুইয়ে রেখেছিস! শুনে রাখ- অচিরেই তোর বংশ নির্বংশ হবে।"
এবার পাল মশাই রেগেমেগে আগুন! সে ঘুমের মধ্যে ঠাকুরের উপর চিৎকার করে বলে উঠলো -
"পারোতো শুধু পাল মশাই'র সাথে; মন্দিরে যে ঢুকলো, তারে কিচ্ছু করতি পারো না?
ন্যা'ড়ের (মুসলিম) বালও ছিড়তি পারো না! পারো শুধু পালের নির্বংশ কত্তি!"
প্রসঙ্গত: আমাদের সমাজে ধর্মের খাঁড়া; সাধারণ মানুষের উপর পড়ে বেশী।
বেচারা পাল মশাইয়ের মতো যারা অনুগত, বিশ্বস্ত, বিনীত ভক্ত, জড়সড় হয়ে থাকে; তাদের উপর নিয়ম কানুন আর ধর্মের থ্রেট বেশি পড়ে। আর যারা ড্যাম কেয়ার, ধর্ম কর্মের নামে অপকর্ম করে; তাদের ছেড়ার হয়তো কেউ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন