“ইন্দুবালা ভাতের
হোটেল”নামে একটা বইয়ের
কভার পেজের ছবি ফেসবুকের কল্যাণে চোখে পড়ছিল
বেশ কিছুদিন হল। লেখকের নাম কল্লোল লাহিড়ী। খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে মনে হয়েছিল কোথাকার
কোন লাহিড়ী, সখ হয়েছে বিভূতিভূষণ হওয়ার। তবু গুগলে সার্চ দিতেই বইটার পিডিএফ ভার্ষণ
পেয়ে গেলাম। পড়ব পড়ব করে আরো কিছুদিন কেটে গেল। গতকাল দুপুরের পর ব্রডব্যন্ড বন্ধ ছিল
কিছুক্ষণ। কি মনে হতেই বইটা ওপেন করে পড়া শুরু করলাম। তখনও কি জানতাম আমার জীবনের আরো
একটি সেরা ভাললাগা বই পড়তে চলেছি আমি?
গল্পটা খুবই সাধারণ।
প্রধান চরিত্র ইন্দুবালা নামে এক সংগ্রামী বিধবা। দোজবরে, মাতাল ও জুয়াড়ি স্বামী’ র
মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে অসহায় ইন্দুবালা যখন ঘোর অন্ধকারে তখনই লছমী নামে স্বামীহারা
আর এক সংগ্রামী মাছ বিক্রেতা নারী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। কিছু অর্থের
বিনিময়ে খেতে চায় লছমী। সেই থেকে শুরু “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” নামে হোটেলটি’র। শুরু হয় ইন্দুবালা’র জীবনের নতুন এক
অধ্যায়। ছোটবেলায় ঠাম্মার কাছ থেকে শেখা পূর্ব
বাংলার রান্নার সাথে শ্বশুড়ীর শেখানো কোলকাতার রান্নার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে ইন্দুবালা নিজেকে
সম্পূর্ণ উজাড় করে দেয় হোটেলটি দাঁড় করাতে। নামে হোটেল হলেও সেখান থেকে শুধু অর্থ উপার্জনের
উদ্দেশ্য কখনই ছিল না ইন্দুবালার। ইন্দুবালার দর্শন ছিল- “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন
সেবিছে ঈশ্বর”। মানুষকে খাওয়ানোর
মধ্য দিয়েই তিনি বিবেকানন্দের ঐ বানী’র সত্যতা উপলব্দি করেছিলেন। তাই ইন্দুবালার হোটেল
কখনই খাবার বেশি হয়ে যায়নি, অর্থ না দিতে পারা মানুষগুলোও কখন বিমুখ হয়নি। এমনি কি
খাবারের উচ্ছিষ্টাংশগুলো পেয়েছে পথের কুকুর বিড়ালগুলো।
গল্পের প্রতিটি অনুচ্ছেদে
নতুন নতুন খাবারের নামের সাথে উঠে এসেছে সেই খাবারকে কেন্দ্র করে ইন্দুবালার জীবনের
ইতিহাস। খুলনার কলাপোতা নামের কোন এক গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইন্দুবালা’র। বাবা-মা আর ঠাম্মার
ভালোবাসায় মেশানো ছিল তার শৈশব। প্রিয় সহপাঠী ভিন্ন ধর্মের মনিরুলের প্রতি প্রথম প্রেম
যখন একটু একটু করে জমে উঠছে তখনই বাবা অনেক আশা করে বিয়ে দিয়ে দেন কলকাতার ছেনু মিত্তির
লেনের এক দোতালা বাড়িতে। কিন্তু প্রথমবার বাড়ির
সামনে পৌছেই ভুল ভাঙ্গে সকলের। মদ্যপ, চরিত্রহীন কপর্দকহীন স্বামীকে কখনই ভালোবাসতে
পারিনী ইন্দুবালা। এভাবেই প্রথম কোলকাতায় আসা, আর কখনই ফিরে যেতে পারেননি তার শৈশবের
কলাপোতা গ্রামে। শুধু কলাপোতা গ্রাম কেন হোটেল ছেড়ে কোন তীর্থ বা অন্য কোথাও কোনদিন
যেতে পারেননি ইন্দুবালা। এই হোটেল, মানুষকে প্রাণভরে খাওয়ানোই যে তার জীবনের সকল ধর্ম-কর্ম।
সত্তর বছর বয়সেও
ইন্দুবালা একাকীত্বকে সঙ্গী করে প্রতিদিন উনুনের আগুণের মাঝেই খুঁজে ফেরে জীবনের স্বার্থকতা।
তবে এই একাকীত্ত্ব তার নিজের সৃষ্টি। ছেলে-মেয়েরা সকলে প্রতিষ্ঠিত, তারা অসংখ্যবার
তাকে অনুরোধ করেছে হোটেলটি বন্ধ করে দিয়ে জীবনের বাকী দিনগুলো তাদের সাথে থাকতে কিন্তু
ইন্দুবালা সেসব কথা কানে তোলেননি। এই হোটেলটিই যে তার প্রাণ, এটা ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে
পারেন না। মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারার যে আনন্দ সেটাই যে তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
কুমড়ো ফুলের বড়া, বিউলির ডাল, ছ্যাঁচড়া, আম তেল, মালপোয়া, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল,
চন্দ্রপুলি আর কচু বাটার মতো খুব সাধারণ গ্রাম্য খাবারগুলো লেখক এমন অসাধারণভাবে উপস্থাপন
করেছেন যা যেকোন পাঠককে ভোজনরসিক করে তুলবে।
বইয়ের প্রায় প্রতিটি
অনুচ্ছেদে অসাধারণ আবেগ উপছে পড়েছে। কখনও রান্নার ফাকে ফাকে শৈশবের সেই প্রথম ভালোবাসা
মনিরুল এসে উঁকি দেয় কখনও বা ঠাম্মার সাথে রান্নার স্মৃতি। তবে হোটেলের সামনের মেছবাড়িতে
থাকা ছেলে-মেয়েগুলো দিদা দিদা বলে যখন ইন্দুবালার রান্না করা খাবার খেয়ে আনন্দে তাকে
জড়ীয়ে ধরে তখন জীবনের সব না পাওয়া ভুলে যায় ইন্দুবালা। ভুলে যায় মাতাল, চরিত্রহীন স্বামীর কথা যে শুধু
তার দেহটাকেই ভোগ করেছে। কিংবা সেই ছোট্ট ভাইটার কথা পাক হানাদার বাহিনী যাকে বাড়িতে
আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল।
বইটা পড়তে গিয়ে যেকোন
পাষণ্ড পাঠকেরও অজান্তে চোখের পাতা ভিজে যাবে। ইন্দুবালার জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা
জুড়ে জুড়ে এক অপূর্ব মোহময় কাহিনীর মধ্যে ডুব দিয়ে পাঠক উপলব্দি করবে গ্রাম বাংলার
চিরায়ত মা, মাসী-পিসি আর ঠাকুরমাদের রান্নার মহত্ত্ব।
লেখক কল্লোল লাহিড়ীকে
আমি চিনি না। এটাই আমার পড়া তার প্রথম বই। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার মত অসংখ্য ক্ষুদ্র
পাঠকের মনরাজ্যে ইন্দুবালা এবং কল্লোল লাহিড়ী
অমর হয়ে ধাকবেন দীর্ঘদিন। এমন আবেগ মিশ্রিত অপূর্ব সাবলীল গল্প বলার দক্ষতা বার বার
মনে করিয়ে দেয় বিভূতিভূষনের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ আর হাজারি ঠাকুরের কথা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন