শনিবার, ৯ মে, ২০২০

নজরুল পত্নী প্রমীলা দেবী

কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা সকলেই চিনি। শুধুমাত্র আমাদের জাতীয় কবি হিসাবেই নয়, তিনি বিদ্রোহী কবি, তিনি সাম্যের কবি, তিনি প্রেমের কবি, তিনি বিরহের কবি। কিন্তু তার জীবন সঙ্গিনী প্রমীলা দেবী/ প্রমীলা নজরুল সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি আমরা? আজকের এই লেখায় আমি সেই মহিয়ষী নারীকেই জানার চেষ্টা করব। এই লেখায় যেসব তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে তার কিছু নজরুলের জীবনের উপর প্রকাশিত বই থেকে এবং কিছুটা ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। 

প্রমীলা নজরুলের প্রকৃত নাম আশালতা সেনগুপ্ত, পারিবারিক ডাকনাম দোলনা (দুলী)। বিয়ের পর কাজী নজরুল ইসলাম তার নতুন নাম দেন প্রমীলা। সেই থেকে তিনি প্রমীলা নজরুল নামেই পরিচিতি পান। প্রমীলা নজরুলের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা গ্রামে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে, বাংলা ১৩১৫ সনের ২৭ বৈশাখ। পিতার নাম বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত, মা গিরিবালা সেনগুপ্ত। তিন ভাইয়ের মধ্যে বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন মেঝ, বড় ভাইয়ের নাম জগত কুমার সেনগুপ্ত এবং ছোট ভাইয়ের নাম ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত। প্রমীলা দেবীর বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের কর্মস্থল ছিল কুমিল্লার কান্দির পাড়েছোটবেলাতেই বাবাকে হারান প্রমীলা দেবী। স্বামীর মৃত্যুর পর গিরিবালা দেবী একমাত্র সন্তান আশালতাকে নিয়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সংসারে আশ্রয় নেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত চাকরি করতেন কুমিল্লা কোর্টে ।

ইন্দ্রকুমার সেনগুপের প্রথম পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব ছিল কলকাতার বিশিষ্ট পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের। আলী আকবর খান তার ভাগ্নী নার্গিসের সাথে নজরুলের বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নজরুলকে সাথে নিয়ে কুমিল্লার দৌলতপুরে যাওয়ার সময় পথে রাত হয়ে যাওয়ায় ইন্দ্রকুমার বাবুর বাড়িতে আথিত্য গ্রহণ করেন এবং সেখানেই আশালতা সেনগুপ্তের সাথে কাজী নজরুলের প্রথম সাক্ষাত হয়। সেটা ছিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ, প্রামীলা দেবী তখন ১২/১৩ বছরের কিশোরী।

আলী আকবর খান ও কাজী নজরুল ইসলাম ইন্দ্রকুমার বাবুর বাড়িতে একরাত্রি অবস্থান করে পরদিনই দৌলতপুর পৌছে যান এবং নার্গিস খনমের সাথে নজরুলের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরপরই নজরুল ইসলামকে ঘরজামাই থাকার প্রস্তাব করা হয় এবং তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সেদিনই আলী আকবর খানের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুর ত্যাগ করে কান্দির পাড়ে চলে আসেন এবং ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে অবস্থান করেন। কাজী নজরুল ইসলাম এসময় প্রায় ২১ দিন প্রমীলাদের বাড়িতে ছিলেন।

কৈশোরে প্রমীলার গায়ের রঙ ছিল চাঁপাকলির মত, কাজী নজরুল ইসলাম সহজেই প্রমীলা দেবীর প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম নিয়মিত কুমিল্লায় আসতে শুরু করেন এবং প্রামীলা দেবীর সাথে তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। প্রমীলা দেবীর প্রতি তার গভীর প্রেম ফুটে ওঠে একটি কবিতায়--

হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে

আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে

আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী

দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী।

এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি

এ হার মানা হার পরাই তোমার কেশে।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দোলন চাঁপা’ প্রমীলার নামে উৎসর্গ করেন। ১৩৩০ সালের আশ্বিন মাসে ‘দোলনচাঁপা’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এভাবেই নজরুল প্রমীলার সম্পর্ক অগ্রসর হতে থাকে। তবে স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পর্ককে তৎকালীন হিন্দু সমাজ প্রশ্রয় দেয়নি। এই সম্পর্কের বিরোধিতা করেছিলেন স্বয়ং বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত। কিন্তু প্রমীলা দেবীর মা গিরিবালা দেবী একমাত্র মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে এই বিয়েতে সম্মতি প্রদান করেন। গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল শুক্রবার কাজী নজরুল ইসলামের সাথে প্রমীলা দেবীর ইসলামী রীতিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়।

বিয়ের পর কাজী নজরুল ইসলাম এবং প্রমীলা নজরুল হুগলীতে একটি ভাড়াবাড়িতে বসবাস শুরু করেন। প্রমীলা নজরুল এবং কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম সন্তান ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের অষ্টমী তিথিতে (শ্রীকৃষ্ণের আর্বিভাব দিবসে) জন্মগ্রহণ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম তাই সন্তানের নাম রাখেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। নবজাতকের আকিকা অনুষ্ঠানে সেই সময়ের বিখ্যাত সব সাহিত্যিক ডা. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মঈনুদ্দীন হোসায়েন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, পবিত্র গঙ্গাপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, দীনেশ রঞ্জন দাশসহ বহু খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিক যোগ দিয়েছিলেন। বিয়ের খাওয়া-দাওয়া হয়নি বলে নজরুল তার বন্ধু ও অনুরাগীদের বিরাট ভুরিভোজে আপ্যায়ন করেন। কিন্তু দূঃখের বিষয় কৃষ্ণ মোহাম্মদ মাত্র চারমাস বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। প্রামীলা ও নজরুল হুগলী ছেড়ে কৃষ্ণনগরে চলে যান। সেখানেই ১৯২৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তাদের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে কবি কৃষ্ণনগর ছেড়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে পানবাগান লেনের বাড়িতেই কবির তৃতীয় পুত্র সানি (কাজী সব্যসাচী) জন্মগ্রহণ করেন। পানবাগান লেনের বাড়ি থেকে নজরুল ইসলাম মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের এক দ্বিতল বাড়িতে যান। সেই বাড়িতেই মে মাসের ৭/৮ তারিখে নজরুল প্রমীলার প্রাণ প্রিয় পুত্র (বয়স ২ বছর ৮ মাস) বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়। ১৯৩১ সালে নজরুলের ৪র্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র নিনির (কাজী অনিরুদ্ধ) জন্ম হয়।

প্রমীলা নজরুল ১৯৩৮ সালে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। এসময়ও কবির প্রতি তার গভীর অনুভূতি পরিচয় পাওয়া যায়। অসুস্থ্য অবস্থায়ও তিনি নিজ হাতে কবির সেবা করতেন। কবির বাসায় আগত কবির ভক্ত ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে তিনি একান্ত আপনজনের মতো ব্যবহার করতেন। সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝেও কখনও তিনি কবিকে অভিযোগ করেননি। দীর্ঘ রোগভোগের পর ৩০ জুন ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রমীলা দেবী শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। প্রমীলার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে নজরুলের জন্মভূমি চুরুলিয়ায় দাফন করা হয়। প্রমীলা দেবীর একান্ত ইচ্ছা ছিল তার পাশেই কবিকেও সমাহিত করা হোক। এ উদ্দেশ্যে তার কবরের পাশে অন্য একটি কবরের জন্য জায়গাও রাখা হয়। কিন্তু তার প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়নি কখনই। কবিকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ সংলগ্ন চত্ত্বরে।

বাল্যকাল থেকেই প্রমীলা দেবী সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভীষণ অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর কিছু কবিতা মাসিক “সওগাত” ও দ্বিমাসিক “সাম্যবাসী” তে ছাপা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন