রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১

ধ্রুবপুত্র- অমর মিত্র

 


বইয়ের হাট নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে অমর মিত্রের একটা সাক্ষাৎকার দেখে ‘ধ্রুবপুত্র’ পড়তে শুরু করেছিলাম। শুরুতেই এই উপন্যাসের ভাষা আমাকে মুগ্ধ করে আবার কেমন যেন বিরক্তও। কথাটা একটু অদ্ভুত শোনালেও এটাই আমার সত্যিকারের অনুভূতি। কাহিনীর মধ্যে প্রবেশ করে একটা ঘোরলাগা অনুভূতি তৈরি হল। মনে হল আমি যেন একটা স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়েছি। প্রাচীন কাহিনী হিসাবে লেখক এখানে স্বার্থক বলেই আমার মনে হয়েছে। বইটি পড়তে পড়তে আমি সত্যিই হারিয়ে গেছিলাম সেই উজ্জয়নী নগরিতে, সেই মহাকালের মন্দির, সেই বৃষ্টিহীন ধূসর প্রান্তর, রাতের তারা মহারাজ ভর্তৃহরি, সেই গণিকালয় যেন বাস্তব হয়ে উঠে এসেছিল আর আমি সেখানে বিচরণ করছি প্রতিটি চরিত্রের সাথে।

       বিশালা নগরীর বৃদ্ধ শিবনাথ যার পুত্র কার্ত্তিককুমার হনুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি, পুত্রবধু রেবা যার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে। পৌত্রী গন্ধবতীও প্রতীক্ষায় আছেন একজনের, তিনি ধ্রুবপুত্র। এদিকে দীর্ঘদিন রাজ্যে বৃষ্টি নেই, মাঠে ফসল নেই, যেসব জলাশয় কখনই জলহীন দেখেনি কেউ, যেখানে সর্বদা পদ্ম ফুটে থাকে সেইসব জলাশয়ও শুখিয়ে গেছে। নিঃসন্তান রাজা ভর্তৃহরির তাই মনে শান্তি নেই। রাতের আধারে একা মহাকালের মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের সাথে দেখা করতে গিয়ে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে মিলিত হন দেবদাসী ললিতার সাথে। ললিতা দীর্ঘদিন প্রতিক্ষায় ছিল মহাকালের প্রতি নিজেকে সমর্পন করে। গভীর রাতে রাজাকে মহাকাল মনে করে নিজেকে সমর্পণ করে তাকে। এভাবেই কাহিনি এগিয়ে চলে ধ্রুবপুত্রে’র।

উপন্যাসটিতে যৌনতা নিয়ে বেশ খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। প্রেমের সাথে যে যৌবন এবং শরীরের স্পষ্ট সম্পর্ক সেটাকে খুবই চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। উজ্জয়নীর নর-নারীর কামদেবের মন্দিরে যাওয়া এবং কামদেবের কাছে প্রার্থনা প্রভৃতি বিষয়গুলো আমার কাছে কাহিনীর নতুনত্ব হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে। অবশ্য লেখক স্পষ্ট করে বলেছেন যে ‘ধ্রুবপুত্র’র সম্পূর্ণটাই কাল্পনিক আর কল্পনায় অনেক কিছুই হতে পারে।

       শুরুতে চুম্বকের মত আকর্ষণ করলেও কিছুটা পড়ার পর অর্থাৎ ৩০/৩৫ পৃষ্ঠা থেকে কিছুটা একঘেয়েমি লেগেছে অবশ্য পাঠক হিসেবে আমার ধৈর্য্য যথেষ্ঠ নয় বলেই আমি মনে করি। সেজন্যেও এমনটা হতে পারে। তবে ৭০/৮০ পৃষ্ঠার পর  থেকে কাহিনীতে আবার নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। যেখানে একদিকে উদ্ভবনারায়ণ নামে সামান্য এক রাজ কর্মচারী গন্ধবতীকে জোর করে বিয়ে করার চেষ্টা করছে, রাজা বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন বণিক সুভগ ভদ্র। মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিত যুক্ত হয়েছেন সেই ষড়যন্ত্রে। সব মিলিয়ে বেশ একটা গতি এসেছে গল্পে।

       “তাম্রধ্বজের সাহায্য প্রয়োজন, কে না সে যুবক। বয়সই তার শক্তি। তাম্রধ্বজ জ্ঞানী। জ্ঞানই তার শৌর্য। উদ্ভবনারায়ণও যুবক, কিন্তু জ্ঞানী নয়। উদ্ভব নারায়ণ রাজকর্মচারী। তার শক্তি হলো রাজার শক্তি। রাজ-শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে জ্ঞানীরাই। একথা বলত ধ্রুবপুত্র।”

       যুবক তাম্রধ্বজ আচার্য্য বৃষভানুর শিষ্য। তিনি জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করছেন। গ্রহ, নক্ষত্র বিচার করে তিনি খুঁজে চলেছেন ধ্রুবপুত্র এবং কার্তিককুমারের। তবে পড়তে পড়তে মনে হবে তাম্রধ্বজ বুঝি গন্ধবতীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ধ্রুবপুত্রের খোঁজ দেওয়ার নাম করে প্রায়শই শিবনাথের গৃহে আগমনের হেতু আর কি হতে পারে? প্রশ্ন আরোও থেকে যায়, শুধুই কি তাম্রধ্বজ? গন্ধবতী কি প্রতীক্ষায় থাকে না তাম্রধ্বজের? হয়তো না, হয়তো তাম্রধ্বজের কাছে ধ্রুবপুত্রের খবর জানার আশাতে তার পথ চেয়ে থাকে।

       সুভগ দত্তের দাস উতঙ্গের মৃত্যু কাহিনীতে নতুন মাত্রা যোগ করে। তবে এরপরই কাহিনী কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়। কেন যেন মনে হয় লেখক ইচ্ছে করেই কাহিনীকে টেনে টেনে লম্বা করেছেন। আমার কাছে কাহিনীর এই স্থানে বেশ কিছু অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা মনে হয়েছে কিংবা পাঠকের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে যেন।

       শেষ পর্যন্ত তাম্রধ্বজের মধ্যেই কি ধ্রুবপুত্রকে খুজেঁ পেলো গন্ধবতী? তাহলে নির্জন অন্ধকার রাতে রাজাকে বৃষ্টি আনার সম্ভাবনা কে দেখালো? সেও কি ধ্রুবপুত্র? কিন্তু সে তো বলল ধ্রুবপুত্রের পুনর্জন্ম হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন