বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০

দ্যা পিরামিড- ইসমাঈল কাদরী


এক সকালে ফারাও চিপস সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি তার জন্য কোনো পিরামিড তৈরি করবেন না। তার এই সিদ্ধান্তে সভাসদ সবাই হতবাক হয়ে পড়লোকোনো পিরামিড তৈরি হবে না! তাহলে কীভাবে রক্ষা পাবে এই দেশ। পিরামিড ছাড়া অশুভ ছায়া এ দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। পিরামিড যদি নির্মাণ করা না হয় তাহলে এ জাতিকে একটা কাজের মধ্যে দাসদের মতো আটকে রাখতে না পারলে দেশে শৃঙ্খলা তৈরি হয়ে যাবে। অবশেষে সভাসদ আর প্রধান কৌশলী হেমিউনির যুক্তিতে ফারাও খুফু (যিনি চিওপস নামেও পরিচিত) রাজি হলেন বিশাল আকৃতির এই সমাধি তৈরি করতে। 

পাথর সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন প্রদেশের পাথর খাদগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। পিরামিড তৈরি করতে গিয়ে অনেক প্রাণ হানি ঘটলো যারা পিরামিড তৈরিতে তাড়াহুড়ো করছিলো তারা সম্রাটের মৃত্যু কামনা করছে এই অজুহাতে তাদেরকে ফাঁসিতে চড়ানোলো আবার যারা কাজে ধীরগতি অবলম্বন করছিল তাদেরকে অলসতার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।

এভাবে সম্রাটের খেয়ালের বসে অনেক লোকের আত্মাহুতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন কাজের পর তৈরি হলো পিরামিড, এক স্বৈরশাসকের অন্তিম শয়ানের স্থান।

এই হচ্ছে বুকার পুরস্কার বিজয়ী ইসমাঈল কাদরী’র বিখ্যাত উপন্যাস “দ্যা পিরামিড” এর কাহিনী সংক্ষেপ।

এই উপন্যাসে পিরামিড সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে। গিজার পিরামিডটি সবচেয়ে বড় এবং একে ঘীরেই আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনী। কল্পিত কাহিনী হলেও এর মধ্যে অনেক তথ্য রয়েছে যা ইতিহাস থেকেই নেওয়া। তাই উপন্যাসটি অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছেও সমাদৃত হয়েছে।

আর্কিওলজিস্টদের মতে গিজার পিরামিড তৈরিতে প্রায় দুই মিলিয়ন পাথর খন্ড ব্যবহার করা হয়েছিলো এবং এক একটা পাথরের ওজন গড়ে ২.৫ টন। পিরামিড তৈরির সময়ে এর উচ্চতা ছিল ৪৮১ ফুট। সেই সময়ে পৃথিবীর আর কোন স্থাপনা এত উচু ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৪৭ থেকে ২৫২৫ পর্যন্ত সময়ে মিশরের শাসক ফারাও খুফু এই পিরামিড তৈরি করেছিলেন। ছবিতে আমরা যে পিরামিড দেখে তা থেকে আসলে সত্যিকারের পিরামিড সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। কেননা পিরামিড এত বিশাল যে তা কোন ক্যামেরার ফ্রেমে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়।

পাশাপাশি তিনটি পিরামিড গিজায়-ফারাও খুফু, খাপড়ে ও মেনকাউড়ে। পাশে আরো কয়েকটা ছোছোট পিরামিড আছে যার গায়ে ধ্বংস ভর করেছে। এই বিশাল চত্বরের সামনে সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে স্ফিংস, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহের আকৃতির দেবতা। পিরামিডের চেয়ে অধিক বিস্ময়কর এই স্কিংস। কারণ এতো বড় অ্যালাবেস্টর পাথর মিসরে দুপ্রাপ্য এবং বিদেশ থেকে নিয়ে এসে তাকে কীভাবে বসানো সম্ভব, যার ওজন এক লাখ পঁচিশ হাজার টন? এ জন্যই বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং কিছু কিছু মিশরীয় মতবাদে বিশ্বাসীদের ধারণা, স্ফিংস ও পিরামিড কোনো মানুষের গড়া ভাস্কর্য নয়। তাদের মতে, এসব ভিন গ্রহের কেউ বানিয়েছে। না হলে স্ফিংসের মুখ এতো কিম্ভুত কেন? স্ফিংসের মুখ আসলেই বিচিত্র। এক দিক থেকে তা নারীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, অন্যদিকে পুরুষের। এসব দেখে নেপোলিয়নের এক গবেষক প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘মোনালিসা কি স্ফিংসের প্রেরণায় আঁকা?

বিভিন্ন ছবিতে পিরামিডগুলো মাটির উপরে দাঁড়ানো ছোট ছোট ত্রিভূজ বা প্রিজমের মত মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হল পিরামিডগুলো তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল আয়াতকার পাথরের টুকরো পাশাপাশি এবং একটার পর একটা সাজিয়ে। প্রথম তাকের ওপর দ্বিতীয় তাক বসানো হয়েছে একটু ভেতরে চেপে। ফলে উপরের আয়তন নিচের চেয়ে সামান্য ছোট হয়েছে। এভাবে ক্রমেই ছোট হতে হতে একেবারে শীর্ষে একটি মাত্র পাথরে শেষ হয়েছে।

বাইরে থেকে পিরামিডকে নিরেট মনে হলেও এর ভিতরে অসংখ্য কক্ষ আর রহস্যময় পথ। প্রতিটি পথেই রয়েছে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। স্বাভাবিক বুদ্ধি যেখানে বিভ্রান্ত হবে। মেনকাউসের পিরামিডের নিচ দিয়ে পানি আসার জন্য নীল নদ পর্যন্ত একটি সুরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে যা বিজ্ঞানীদের করে দিয়েছে হতবাক। আধুনিক সকল স্থাপত্যবিদ্যাকে বিস্মিত করে গত তিন হাজার বছরে অসংখ্য ভূমিকম্পেও হেলায় তুচ্ছ করেছে এই পিরামিড।

পিরামিডের একটা আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এর ত্রিকোণমিতিক হিসাব এবং আনুভূমিক গঠন। পিরামিডের প্রতিটি কৌণিক রেখার সাথে মেলানো হয়েছে মহাকাশের নক্ষত্ররাজিকে। দক্ষিণ কোন থেকে শীর্ষে তাকালে দেখা যায় ধ্রুবতারা। উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে তাকালে বৃশ্চিকের কেন্দ্রবিন্দু দেখা যায়। মহাশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এটা শুধুমাত্র বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনেই দেখা যায় যে দিনে সম্রাট খুফু মারা গিয়েছিলেন, দশই ডিসেম্বর। এবং অদ্ভুত তথ্য হচ্ছে সম্রাট খুপু মারা যান মিরামিড তৈরি সম্পন্ন হওয়ার তিন বছর পূর্বে। তৎকালীন স্থাপত্যবিদ ও জ্যোর্তিবিদরা কিভাবে এমন একটি কাজ সম্পাদন করলেন তা হয়তো চিরদিনই রহস্যবৃত থেকে যাবে।

পিরামিডের পশ্চিমের শীর্ষ বিন্দু দিয়ে আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় আদম সুরাতের মাথার তিনটি তারা, এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যা মিশরের বসন্তকাল। দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে তাকালে দেখা যাবে সপ্তর্ষিমন্ডলের লুব্ধক, জুনের পনেরো তারিখ যেদিন সম্রাটের জন্ম হয়েছিল। পিরামিড গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন যে, পুরো স্থলমন্ডলের কেন্দ্র খুপুর পিরামিডের সরাসরি নিচে।

সম্রাট নেপোলিয়নের সাথে থাকা গবেষকরা পিরামিড নিয়ে গবেষণা করে এটা প্রামাণ করেছেন যে, গিজার তিনটি পিরামিডে যে পরিমাণ পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তা দিয়ে ফ্রান্সের সীমানা ছয় ফুট উঁচু এবং তিনজন ঘোড়সওয়ার যার উপর দৌড়াতে সক্ষম এমন দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া সম্ভব।

একবিংশ শতাব্দিতে বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির অসাধারণ অগ্রগতি সত্ত্বেও পিরামিডের নির্মাণ কৌশল নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের তত্ত্বই এখন পর্যন্ত সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য সমাধান। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সালে তিনি যখন পিরামিডগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তখন পিরামিডগুলোর বয়স প্রায় দুই হাজার বছর। তিনি মত প্রাকাশ করেন পাথরগুলো ওপরে ওঠানোর জন্য ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছিল। সিসিলির ডিডোরাস তারও ৩০০ বছর পরে একটা নতুন ধারণ দেন। তিনি বলেন, পাথর ওঠানোর জন্য মাটির দিয়ে র‍্যম্পের মত বানানো হয়েছিল যার উপর দিয়ে পাথরগুলো সহজেই টেনে তোলা হয়েছিল।

অনেকে আবার পিরামিড তৈরিতে ভিনগ্রহের প্রাণিদের সাহায্য তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। পিরামিডের বিশাল আকার এবং বিশেষ করে স্ফিংসএর অদ্ভুত আকৃতির কারণেই অনেকে মনে করেন এটা তৈরিতে ভিনগ্রহের কোন প্রাণির অবদান থাকতে পারে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন